রংপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার (বর্তমানে লালমনিরহাট
জেলার অন্তর্গত) তিস্তাপারের ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম কাকিনা । সেকালে
সবচ্ছতোয়া তিস্তার ওপার থেকে কাকিনার
অপূর্ব সুন্দর গাছগুলো দেখা যেত । নিসর্গের বিশিষ্টতা, পথঘাট, প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান, আবহ গ্রামটির
গন্ডগ্রামের পরিচয়কে মুছে দিত।
কাকিনা চাকলার অধিকার লাভের পেছনে আছে অষ্টাদশ শতকের পশ্চাদপট । মুঘল ফৌজদারের অগ্রাভিযানের
ইতিহাস । কৃপালাভে সমর্থ হয়ে জমিদার বংশের প্রতিষ্টা । সামন্ততান্ত্রিক এস্টেটের
কাঠামোতে কাকিনার আত্মপ্রকাশ । সেই সূত্রে ধীরে ধীরে কাকিনার বনেদীপনার চর্চা , শিক্ষার বিস্তার ও সংস্কৃতি চর্চার যাত্রারম্ভ । উপর কাঠামোয় আভিজাত্যের পালিশ এসে কাকিনাকে করে বিশিষ্ট
। এ বিষয়ে কাকিনা রাজবাড়িকে বাদ দিলে অতীতের পরিচয় থাকে অনেকটাই অজানা ।
চরিত্রগুণে সুখ্যাত কাকিনার প্রজাবৎসল রাজা মহিমারঞ্জনের জন্ম ১৮৫৩
খ্রীস্টাব্দ । কাকিনার জমিদার শম্ভূচন্দ্র রায় চৌধুরীর দত্তকপুত্র হলেও কাকিনাকে যথেষ্ট আলকিত করেছিলেন
মহিমারঞ্জন । গ্রামীন কৃষি ও শিল্প উত্পাদনে প্রশিক্ষণ ও পুরস্কার প্রবর্তন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিশাল জাদুঘর ও লাইব্রেরী স্থাপন, কাকিনা থেকে সাপ্তাহিক "রংপুর দিক প্রকাশ" (১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের শম্ভুচন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত) পরিচালনায় অবদান, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
গ্রন্থাদির সংগ্রহশালা মহিমারঞ্জন লাইব্রেরী
স্থাপন, কাকিনা এম, ই স্কুলের উন্নয়ন - এককথায় শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায়
কাকিনার আলাদা একটি মহিমা তৈরি করেছিলেন মহিমারঞ্জন
। প্রচুর শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও অল্প সংখ্যক বনেদী মুসলিম পরিবারকে ঘিরে কাকিনার
সুধী সমাজ গড়ে ওঠে । সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার একটি রোল মডেল তৈরি হয় । মহিমারন্জনের
পুত্র মহেন্দ্ররঞ্জন রায় চৌধুরী কর্তৃক পিতার স্মৃতিরক্ষায় ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কাকিনা
মহিমারঞ্জন মেমোরিয়াল হাই ইংলিশ স্কুলের প্রতিষ্ঠায় নতুন মাত্র যুক্ত হয় । সর্বসাধারন্যে
এই স্কুলের প্রভাব ছিল গভীর হেডমাস্টার বাবু গিরিজাশন্কর গুপ্তের বেক্তিত্ব ও পরিচালনায়
এবং সুযোগ্য শিক্ষক মন্ডলীর স্পর্শগুনে শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে কাকিনার অবদান হয়
সর্বজনস্বীকৃত । শিক্ষার্থীদের শোনা হয়ে ওঠার
এই ঐতিহ্য পঞ্চাশের দশক অবধি অনেকটা অব্যহত থাকে । বিস্মৃতকালের এই ইতিবৃত্ত কাকিনার
অতীত । কাকিনার কথা ভাবলে মনে পরে নকল মাটির পাহাড়, ব্রাহ্মমসমাজ ভবন, ঘাট বাধানো বিশাল
সম্ভুসাগর, পাবলিক থিয়েটার হল, মুখরিত খেলার মাঠ, ফুলে ফুলে ছাওয়া বিস্তৃত মনোরম পথ,
পথের মোড়ে বাতির স্ট্যান্ড, অসাধারণ বৃক্ষরাজি, স্বাস্থ্য প্রদায়িনী তিস্তা পারের খোলা
হওয়া । হাট-বাজার, মাছ, শাক সবজি, ফলমূলের সুলভ প্রাপ্যতা এবং আরো নানা স্মৃতিকথা । মনে পড়ে সেই সব মানুষের কথা যারা কাকিনাকে
গৌরব দান করেছিলেন । এক কথায় ভালবাসায় সিক্ত হয়েছে এই গ্রাম - যা আজো স্মৃতিতে অম্লান । এখনো কাকিনাকে
যারা ঘিরে আছেন তারা এসব কথা ভাবেন । এই আবহে কাকিনার কবি, "স্বর্গ - নরক"
কবিতার কবি, সুখ্যাত গদ্য লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক শেখ ফজলল করিমের সাহিত্য জীবন
কর্ম পরিচালিত হয়েছিল । ৫৮ খানারও অধিক গ্রন্থ সংখ্যা যার - তিনি বাস করেছিলেন এ গ্রামে
। কাব্য ভূষণ, সাহিত্য বিশারদ, কাব্যরত্নাকর নানা উপাধি ও পদক কবির সঙ্গে কাকিনাকেও
এনে দিয়েছে গৌরবের
মহিমা ।
এছাড়া বহু শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, সমাজকর্মী,সাহিত্য
সমঝদারে কাকিনা ছিল আলোকিত । এই কাকিনা বিশ, ত্রিশ, চল্লিশের শতকের ব্রিটিশ আবহ অতিক্রম
করে পাকিস্তান পর্বে প্রবেশ । করেছিল এরপর পুরনো ধারাবাহিকতা, কিছু ভগ্নাংশ, কিছু অবশিষ্ট
নিযে ২৪ বছর পার করেছে কাকিনা । তত্কালীন আইযুব উদ্ভাবিত থানা কেন্দ্রিক প্রশাসনের
আওতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে কাকিনা তার লাবন্য হারায় । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা
সংগ্রামের ভিতর দিযে কাকিনার উত্থান পর্বের
সুচনা । সাধারণ মানুষ বিগত কালের অবস্থান থেকে অনেকটা এগিয়ে আসে । দারিদ্র সত্তেও শিক্ষার্থীদের
সংখ্যা হয় বহুগনিত । সাধারণ কৃষি পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা পুরনো দিনের শ্রেণীগত দেয়াল
ভাঙ্গতে সক্ষম হয় । উঠতি শ্ক্ষিত এই কৃতি সন্তানের স্বদেশ বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান
নেয় স্থাপিত হয় স্কুল - কলেজ - কিন্ডার গার্ডেন কাকিনা রাজবাড়ির ধংসাবশেষের উপরে গড়ে
উঠে উত্তর বাংলা কলেজ । আরণ্যক কাকিনা যুক্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মূল উন্নয়ন প্রবাহের
সঙ্গে । হাই - ওয়ে চলে যায় কাকিনার বুক চিরে ।
বিদ্যুতায়িত হয়ে উঠে কাকিনা । যোগাযোগে ঘটে অভাবিত পরিবর্তন । দিন বদলের ধারা চোখে পড়তে
থাকে । ব্যবসা - বানিজ্যে দেখা দেয় প্রাণ চাঞ্চল্য । জনপদের মানুষজন দেখতে পায় অন্যান্য
জেলা (বিশেষত: ময়মনসিংহ) থেকে আগত সাচারণ মানুষ তিস্তার চরাঞ্চল সবুজ কৃষিক্ষেত্রে
পরিনত করেছে । যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন আবাস ।
এদিকে
কাকিনাবাসী হতে থাকে সবত্রগামী । খানিকটা হালকা নাগরিকতার ছায়া পড়তে থাকে কাকিনায় । দেশ স্বাধীন হলে স্বাধীনতার তলানি চুইয়ে
পরে সাধারণ নিয়মে । কাকিনার প্রাপ্তি এখনো অনেক দূরে । কারণ কৃষিভিত্তিক কাঠামো আবহমানকালের
অপরিবর্তিত ও স্থবির । উচ্চ ফলনশীল ফসলের চর্চা ও কিছু নতুন প্রযুক্তি দারিদ্রকে সহনশীল
করেছে মাত্র । তাড়াতে পারেনি । রাজতন্ত্র গেছে, সমাজতন্ত্র বিলীয়মান । গণতন্ত্রের সুফল
এখনো আশার মুখ দেখেনি । উজ্জল অনাগত দিনের প্রত্যাশায় কাকিনা অপেক্ষমান । হওয়া বইতে
শুরু করেছে । জয়তু কাকিনা ।
আবদুস সালাম
কবিবাড়ি
কাকিনা
কবিবাড়ি
কাকিনা
Keine Kommentare:
Kommentar veröffentlichen